২০২০ সালের মহামারির কারণে শিক্ষাব্যবস্থায় যে বিপর্যয় নেমে আসে, তার অন্যতম উদাহরণ ছিল পরীক্ষা ছাড়া শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন। এই সিদ্ধান্তের অংশ হিসেবে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ‘সাবজেক্ট ম্যাপিং’ পদ্ধতি ব্যবহার করে আগের দুই পাবলিক পরীক্ষার ভিত্তিতে ২০২০ সালের উচ্চ মাধ্যমিকের (এইচএসসি) ফলাফল ঘোষণা করে। কিন্তু এই পদ্ধতি নিয়ে দেখা দেয় নানা প্রশ্ন। কেন আগের পরীক্ষায় ভালো ফল করা শিক্ষার্থীরা এবার কাঙ্ক্ষিত ফল পায়নি, আবার অনেকেই কেন অপ্রত্যাশিতভাবে জিপিএ ৫ অর্জন করেছেন?
জুলাই বিপ্লব,বন্যাসহ নানান কারণে এবারের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা ২০২৪ সম্পূর্ণরূপে নেয়া সম্ভব হয়নি। বাংলা,ইংরেজি,আইসিটি প্রভৃতি পরীক্ষা নেয়া সম্ভব হলেও বিজ্ঞান বিভাগের কোনো পদার্থবিজ্ঞান ১ম পত্র বাদে কোনো পরীক্ষাই নেয়া সম্ভব হয়নি। তাই এবার ও কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সাবজেক্ট ম্যাপিং পদ্ধতির। তো সাবজেক্ট ম্যাপিং কী? কীভাবে ফলাফল তৈরি হবে ২০২৪ উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের?
তাই আজকে আমরা আলোচনা করবো, এই সাবজেক্ট ম্যাপিং পদ্ধতি সম্পর্কে।
আলোচনা করবো, এই পদ্ধতি কীভাবে কাজ করে, কেন এমন বিচিত্র ফলাফল হয়, এবং এর সামাজিক ও মানসিক প্রভাব কী হতে পারে। এই ব্লগে আমরা সাবজেক্ট ম্যাপিং পদ্ধতির মাধ্যমে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল নির্ধারণের পুরো প্রক্রিয়াটি ব্যাখ্যা করব।
সাধারণত পাবলিক পরীক্ষার ফল নির্ধারণ করতে সরাসরি পরীক্ষা নেওয়া হয়। কিন্তু বিপ্লব,বন্যাসহ অন্যান্য নানান কারণে এবার সরাসরি কোনো পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব হয় নি। তাই শিক্ষা অধিদপ্তর সিদ্ধান্ত নেয়, আগের দুইটি পাবলিক পরীক্ষা—এসএসসি (মাধ্যমিক) এবং জেএসসি (জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট)—এর ফলের উপর ভিত্তি করে এইচএসসির ফল নির্ধারণ করা হবে। এ জন্য তৈরি করা হয় একটি নীতিমালা, যার মাধ্যমে ‘সাবজেক্ট ম্যাপিং’ পদ্ধতি ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশ করা হয়।
সাবজেক্ট ম্যাপিং মূলত একটি প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে শিক্ষার্থীর আগের পরীক্ষার ফলাফলগুলো নির্দিষ্ট অনুপাতে বর্তমান পরীক্ষার বিভিন্ন বিষয়ের নম্বরের সঙ্গে সমন্বিত হয়। এ পদ্ধতির মূল উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষার্থীদের উপর চাপ কমানো এবং পরীক্ষার জন্য সৃষ্ট অসুবিধাগুলো থেকে তাদের মুক্ত রাখা।
এ পদ্ধতিতে ফল ঘোষণার ক্ষেত্রে পূর্ববর্তী দুইটি পাবলিক পরীক্ষার ফলের সঙ্গে সমন্বয় করা হয়। কীভাবে এই সাবজেক্ট ম্যাপিং হয়েছে সে সম্পর্কে বিগত বছরগুলোর তথ্য অনুসারে, অবশিষ্ট বিষয়সমূহের নম্বর এসএসসি/সমমান ও জেএসসি/জেডিসি থেকে সাবজেক্ট ম্যাপিং এর মাধ্যমে নির্ধারণ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে জেএসসি/সমমানের ২৫% এবং এসএসসি/সমমানের ৭৫% নম্বর বিবেচনায় নেয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে আরও জানানো হয়েছে, ‘চতুর্থ বিষয়ের ক্ষেত্রে- যে ৩টি নৈর্বাচনিক বিষয়ের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে সে বিষয়গুলো ব্যতীত চতুর্থ বিষয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এসএসসি/সমমান পরীক্ষার বিষয় ও জেএসসি/জেডিসি পর্যায়ের সামঞ্জস্যপূর্ণ বিষয় হতে সাবজেক্ট ম্যাপিং এর মাধ্যমে নম্বর নির্ধারণ করা হয়েছে। উদাহরণ-চতুর্থ বিষয় উচ্চতর গণিত এর ক্ষেত্রে এসএসসি/সমমান পরীক্ষার উচ্চতর গণিত ও জেএসসি/জেডিসি এর বিজ্ঞান ও গণিত বিষয়ে প্রাপ্ত গড় নম্বর এবং চতুর্থ বিষয় জীববিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এসএসসি/সমমান পরীক্ষার জীববিজ্ঞান ও জেএসসি/জেডিসি এর বিজ্ঞান ও গণিত বিষয়ে প্রাপ্ত গড় নম্বর সাবজেক্ট ম্যাপিং এর মাধ্যমে নির্ধারণ করা হয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ:
বিজ্ঞান বিভাগের বিষয়সমূহ: জেএসসি/জেডিসির গণিত ও বিজ্ঞান এবং এসএসসির পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, উচ্চতর গণিত/জীববিজ্ঞান বিষয়ের ফলের ভিত্তিতে নম্বর গণনা করা হয়েছে।
মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ: একইভাবে, মানবিক এবং ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্যও সাবজেক্ট ম্যাপিংয়ের মাধ্যমে ফল প্রকাশ করা হয়।
২০২০-২১ এ ফলাফল প্রকাশের পর দেখা যায়, অনেক শিক্ষার্থী তাদের প্রত্যাশিত ফলাফল পায়নি। কিছু শিক্ষার্থী, যারা পূর্বের পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করেছে, তারা এবার জিপিএ ৫ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। অন্যদিকে, যারা পূর্বের পরীক্ষাগুলোতে জিপিএ ৫ পায়নি, তাদের মধ্যে অনেকেই এবার জিপিএ ৫ পেয়েছে।
এর কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, সাবজেক্ট ম্যাপিং পদ্ধতি প্রত্যেক বিষয়ের নম্বরকে সমানভাবে বিবেচনা করে না। বিশেষ করে, চতুর্থ বিষয়ের নম্বর সেবারের ফলাফলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। ফলে অনেক শিক্ষার্থী, যারা চতুর্থ বিষয় থেকে অতিরিক্ত নম্বর পেয়ে আগের পরীক্ষাগুলোতে জিপিএ ৫ পেয়েছিল, তারা সেবার সেই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
ফলাফল ঘোষণার পরপরই শিক্ষার্থীদের অভিভাবক ও সমাজের অন্যান্য অংশে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। অনেকেই সন্তুষ্ট ছিলেন না কারণ তাদের সন্তানরা পূর্বের পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করা সত্ত্বেও এবার জিপিএ ৫ পায়নি। অন্যদিকে, অনেক অভিভাবক খুশি ছিলেন, কারণ তাদের সন্তান পূর্বের পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করতে না পারলেও এবার আশানুরূপ ফল অর্জন করেছে।
এই বৈষম্যমূলক ফলাফলের কারণে শিক্ষার্থীদের মাঝে মানসিক চাপও বেড়ে যায়। যেসব শিক্ষার্থী মনে করেছিল তারা সর্বোচ্চ ফল পাবে, তারা অনেকেই হতাশ হয়। আবার, যারা আশা করেছিল সাধারণ ফলাফল করবে, তারা আশ্চর্য হয়ে যায় তাদের প্রাপ্ত ফলাফল দেখে।
চলতি বছরের এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের প্রস্তুতি নিয়েছে আন্তঃশিক্ষা বোর্ড। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী ৬ থেকে ৯ অক্টোবরের মধ্যে এই ফল প্রকাশ করা হতে পারে। এবার পুরো এইচএসসি পরীক্ষা শেষ করা সম্ভব হয়নি। ১৩টি বিষয়ের মধ্যে কেবল ৭টি পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব হয়। পরীক্ষার্থীদের দাবির প্রেক্ষিতে বাকি পরীক্ষাগুলো বাতিল করে সাবজেক্ট ম্যাপিং করে ফলাফল প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
সাবজেক্ট ম্যাপিং পদ্ধতি একদিকে কিছু শিক্ষার্থীকে সুবিধা দিয়েছে, অন্যদিকে কিছু শিক্ষার্থীকে বঞ্চিত করেছে। যদিও এই পদ্ধতি মহামারির মতো বিশেষ পরিস্থিতিতে একটি কার্যকর সমাধান ছিল, তবে এর কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। ফলাফল তৈরিতে এই পদ্ধতির সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা হলো, এটি শিক্ষার্থীর চূড়ান্ত মূল্যায়নে কোনো নতুন যোগ্যতার প্রতিফলন ঘটায় না। বরং এটি পূর্বের পরীক্ষার ফলাফলের উপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নেয়।
এই ফলাফলের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা পরবর্তী উচ্চশিক্ষায় প্রবেশের সুযোগ পেয়েছে। ঢাবি, মেডিক্যাল, ডেন্টাল, রাবি, জাবি, চবি, কৃষিগুচ্ছ, ইঞ্জিনিয়ারিং গুচ্ছ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট এবং অন্যান্য উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ভর্তির সুযোগ উন্মুক্ত হয়েছে।তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, ফলাফলের এই বিচিত্র পরিস্থিতি শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি করেছে এবং তারা নিজেদের দক্ষতা ও মেধার মূল্যায়ন নিয়ে দ্বিধায় পড়েছে।
সাবজেক্ট ম্যাপিং পদ্ধতি শিক্ষাব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন হলেও এটি কিছু প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এ অনাকাংখিত উদ্ভূত পরিস্থিতিতে পরীক্ষা ছাড়াই শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা প্রয়োজন ছিল। কিন্তু এই পদ্ধতিটি পুরোপুরি সফল হয়েছে কিনা তা নিয়ে বিতর্ক রয়েই গেছে। শিক্ষার্থীদের মানসিক অবস্থা এবং তাদের ভবিষ্যত উচ্চশিক্ষায় এই ফলাফল কিভাবে প্রভাব ফেলবে তা সময়ই বলে দেবে।
পরবর্তী সময়ে শিক্ষাব্যবস্থার সংকট মোকাবিলা করার জন্য আরও কার্যকর ও শিক্ষার্থীবান্ধব পদ্ধতি তৈরি করা প্রয়োজন, যা শিক্ষার্থীদের দক্ষতা ও মেধার সঠিক মূল্যায়ন নিশ্চিত করতে পারবে।
তো দারুণ না? চর্চা চালিয়ে যাও!
শুভকামনা রইলো।
আর ফ্রীতে প্র্যাক্টিস করতে এখন ই ইন্সটল করো চর্চা অ্যাপ-