
নটর ডেম কলেজ,ঢাকা বা NDC কে বাংলাদেশের সেরা কলেজ বলা হয় । এসএসসি পাশ করুয়া মোটামুটি বিপুল সংখ্যক ছাত্রের স্বপ্ন থাকে এ নটরডেম কলেজে পড়ার কেননা ইউনিভার্সিটি ভর্তি পরীক্ষায় এ কলেজে রয়েছে অভাবনীয় সাফল্য । কিন্তু কিভাবে এই কলেজটি এত ছাত্রের সাফল্য নিতে পারছে ? কি কি গোপন রহস্য রয়েছে এ সাফল্যের পিছনে আসুন জেনে নেওয়া যাক !!
• ইতিহাস ও পরিচিতি:
রাজধানী ঢাকা শহরের মতিঝিল-আরামবাগ এলাকায় স্থাপিত নটর ডেম কলেজ প্রথমে ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে পুরনো ঢাকার লক্ষ্মীবাজার এলাকায় 'সেন্ট গ্রেগরী কলেজ' নামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ১৯৫৪-৫৫ শিক্ষাবর্ষে তা বর্তমান এই নিজস্ব ভবনে স্থানান্তরিত হয় এবং কলেজের নাম পরিবর্তন করে 'নটর ডেম কলেজ' রাখা হয়। রোমান কাথলিকদের দ্বারা পরিচালিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হলেও এই কলেজে সকল ধর্মাবলম্বী ছাত্রই অধ্যয়ন করতে পারে। কলেজটি পরিচালিত হয় হলিক্রস সন্ন্যাস-সংঘের ফাদারদের দ্বারা। বিদ্যা অর্জনের সাথে সাথে চারিত্রিক গুণাবলী বিকাশে সহায়তা করে ছাত্রদেরকে পূর্ণাঙ্গ মানুষ ও দায়িত্বশীল নাগরিক রূপে গড়ে তোলায় কলেজের লক্ষ্য ।
অনেক প্রতিষ্ঠানের নামের পেছনে একটি ইতিহাস বা উদ্দেশ্য থাকে। প্রতিষ্ঠান শুরু করার উদ্দেশ্য, তার নীতি ও আদর্শ অনেক সময় এই নামকরণের মধ্য দিয়েই প্রকাশ পায়। 'নটর ডেম' নামের অর্থ কী? এই নামকরণের মধ্য দিয়ে কি কোনো উদ্দেশ্য প্রকাশ পেয়েছে? নটর ডেম (Notre Dame) শব্দ দু'টো ফরাসি ভাষা থেকে নেয়া। ইংরেজিতে এর অনুবাদ হচ্ছে: 'Our Lady'। রোমান কাথলিকগণ 'Our Lady' বলতে যিশুখ্রিস্টের জননী মারীয়া বা মেরীকে বুঝে থাকে। তাঁর প্রতি তাদের অগাধ ভক্তিশ্রদ্ধা প্রকাশ করার জন্যই বাইবেলবর্ণিত সেই মহীয়সী নারীকে তারা এভাবে সম্বোধন করে থাকে। নটর ডেম কলেজ সেই মহীয়সী নারী মরিয়মের নামে উৎসর্গীকৃত। যিশুখ্রিস্টের 'জ্ঞানে ও বয়সে, ঈশ্বর ও মানুষের ভালোবাসায়' বেড়ে ওঠায় মারীয়ার ভূমিকা ছিল অনন্য, তাঁর সেই মাতৃসুলভ স্নেহ-ভালোবাসা দিয়ে ছাত্রদের প্রকৃত মানুষরূপে গড়ে উঠতে সহায়তা করার জন্যই নটর ডেম কলেজের এই নামকরণ। প্রধান ফটক দিয়ে কলেজ প্রাঙ্গণে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ে বালক যিশুকে শিক্ষাদানরত সেই মাতা মেরীর মোজাইক-করা চিত্র।
নটর ডেম কলেজের মূলনীতিকে যে কথার দ্বারা প্রকাশ করা হয়েছে তা হল: "Diligte Lumen Sapientiae"। শব্দগুলো লাতিন ভাষা থেকে, যার ইংরেজি অনুবাদ হচ্ছে "Love the light of wisdom' অর্থাৎ 'জ্ঞানের আলোকে ভালোবাসা'। ঈশ্বর হচ্ছেন। সকল জ্ঞানের উৎস।
কলেজের প্রতীকের মাঝখানে রয়েছে একটি খোলা পুস্তক-যার এক পৃষ্ঠায় লেখা আছে 'আলফা' অর্থাৎ গ্রিক হরফের আদি অক্ষর এবং অপর পৃষ্ঠায় লেখা রয়েছে 'ওমেগা অর্থাৎ গ্রিক হরফের অন্ত্য অক্ষর। স্বয়ং ঈশ্বর হচ্ছেন সমস্ত কিছুর আদি বা উৎস এবং সমস্ত কিছুর শেষ বা পরম লক্ষ্য। বই হচ্ছে জ্ঞানের বাহক বা প্রতীক। কলেজের প্রতীকে দেখা যায় তিনটি ক্ষেত্র। বামদিকের ক্ষেত্রে দেখা যায় ৭টি 'Fleurs de-lis', এটি ফরাসি শব্দ যার বাংলা রূপান্তর হচ্ছে পদ্মফুল। পদ্ম হচ্ছে বিশুদ্ধতার প্রতীক। যিশুর মাতা মেরী ছিলেন পদ্মের ন্যায় শুচি ও পবিত্র। ৭টি পদ্ম দ্বারা মাতা মেরীর জীবনের ৭টি শোককে প্রকাশ করা হয়েছে। ডানদিকের ক্ষেত্রটি বাংলাদেশের ভূমিতে কলেজটির অবস্থানের প্রতীক। আমাদের এ মাতৃভূমি সবুজে-শ্যামলে সুন্দর। উদীয়মান সূর্য নতুন দিনের নতুন আশার প্রতীক।
নিচের ক্ষেত্রটিতে আড়াআড়িভাবে বসানো নোঙরদ্বয়ের মাঝখানে স্থাপিত ক্রুশটি হলিক্রস সন্ন্যাস-সংঘের প্রতীক। নোঙর হচ্ছে আশার প্রতীক। ক্রুশ থেকে চারিদিকে যে আলো ছড়িয়ে পড়ছে তা যিশুখ্রিস্টের আলো ও মহানুভবতারই প্রতীক।
ছবি সুত্রঃ নটর ডেম কলেজ ওয়েবসাইট
• পড়াশোনার মান:
এ কলেজের সকল বিভাগের পাঠদান অভিজ্ঞ শিক্ষকদের মাধ্যমে নেয়া হয় । এ কলেজের কিছু শিক্ষকের নিজেদের লেখা বই রয়েছে এছাড়া বোর্ড কর্তৃক দেয়া বইগুলোতেও এ কলেজের শিক্ষকের লেখনী রয়েছে । এদের মধ্যে অন্যতম হলো সঞ্জিত কুমার গুহ স্যারের রসায়ন বই, বিপ্লব স্যারের রসায়ন বই , গাজী আজমল স্যারের জীববিজ্ঞান বই, ফরহাদ মনজুর স্যারের আইসিটি বোর্ড বই ইত্যাদি।
২০২৪ সালের এইচএসসি পরীক্ষায় ৩২৬৩ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে ৩২৬১ জন পাস করে এবং পাশের হার ছিল ৯৯.৯৪% এবং জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ২৬২১জন । এবং বৃত্তি পেয়েছে ৬৬০ জন যা একক কলেজ হিসেবে সর্বোচ্চ।
ভার্সিটি ভর্তি পরীক্ষার কথায় আসলে ২০২৩ সালে ৬৫০+ জন বুয়েটে , ৭৫০+ জন মেডিকেলে , ৯০০+ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, ১২৫০+ জন কুয়েট চুয়েট রুয়েটে চান্স পেয়েছে এছাড়াও অন্যান্য ভার্সিটি তে আরো অনেক নটরডেমিয়ান চান্স পেয়েছে।
• ক্যাম্পাস জীবন ও সুযোগ-সুবিধা:
নটরডেমিয়ান দের জীবনের সাথে কুইজ ও ল্যাব ওতপ্রোত ভাবে জড়িত । দৈনিক ৬টি করে ক্লাস হয় প্রতিটি ক্লাস ৪০ মিনিটের এবং মাঝে ৫মিনিট করে বিরতি রয়েছে । এছাড়াও সপ্তাহে ২দিন কুইজ পরীক্ষা থাকে এবং ল্যাব ক্লাস থাকে । এছাড়াও বুধবার শেষের পিরিয়ড রাখা হয়েছে ক্লাস পিরিয়ড হিসেবে ।
এখানে ছাত্র ও শিক্ষকদের জন্য মোট ১২০ আসন বিশিষ্ট দু'টি পাঠকক্ষ রয়েছে। ছাত্রদের পাঠকক্ষে রয়েছে কাউন্টার, যেখানে পুস্তক আদান-প্রদান করা হয়। গ্রন্থাগারে সাধারণজ্ঞান, দর্শন, ধর্ম, সমাজ বিজ্ঞান, ভাষা, মৌলিক বিজ্ঞান, প্রযুক্তি বিদ্যা, চারুকলা, সাহিত্য ইতিহাস, ভূগোল ও জীবনীমূলক পুস্তক রয়েছে। উল্লেখ্য, এখানে শুধু উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের পুস্তকই নয়, বরং স্নাতক পর্যায়ের, এমনকি স্নাতকোত্তর শ্রেনির পুস্তকও রয়েছে। গ্রন্থাগারে নিয়মিত ৬টি দৈনিক পত্রিকা, ৪টি সাপ্তাহিক ও ২টি মাসিক ম্যাগাজিন রাখা হয়। এছাড়াও অনেক গুরুত্বপূর্ণ জার্নাল ও ম্যাগাজিন রাখা হয়ে থাকে। গ্রন্থাগারে একটি কক্ষ শিক্ষকদের জন্য নির্ধারিত আছে।
এ কলেজে রয়েছে পদার্থবিজ্ঞান , রসায়ন , জীববিজ্ঞান , আইসিটি এর জন্য আলাদা আলাদা ল্যাব। সিলেবাসের সকল পরীক্ষণই ল্যাবে সম্পন্ন করানো হয় । এছাড়াও ল্যাবে সকলের জন্য আলাদা আলাদা যন্ত্রপাতি , কেমিক্যাল, কম্পিউটার ইত্যাদির ব্যবস্থা রয়েছে।
এ কলেজের খুবই আধুনিক এবং সাজানো গোছানো । ছাত্রদের চোখের সামনেই রান্না হচ্ছে এবং পরিবেশন করা হচ্ছে । সকালের নাস্তা, দুপুরের খাবার সহ নানা ধরনের স্ন্যাকস আইটেম পাওয়া যায় এ ক্যান্টিন এ। এছাড়াও চা কফি ও কোমল পানীয় তো আছেই।
সবকিছু মিলিয়ে এ কলেজের পরিবেশ অত্যন্ত ভালো পুরো ক্যাম্পাসই গাছে ঢাকা । গাছ বেশি থাকার কারণে গরম অনেকটাই কম অনুভূত হয়। এছাড়াও পুরো ক্যাম্পাস পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখা হয় সবসময়। এবং সকল নটরডেমিয়ান বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করে সবাই মিলেমিশে পাঠ গ্রহণ করে। এবং সবসময় কুইজের ব্যবস্থা থাকায় কিছুটা প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশও বিদ্যমান।
• ভর্তির নিয়মাবলি :
নতুন শিক্ষার্থীদের ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে কলেজে নেয়া হয়। এজন্য প্রথমেই এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেতে হবে । পরবর্তীতে নটর ডেম কলেজের ওয়েবসাইটে দেয়া বিজ্ঞপ্তি অনুসারে আবেদন করতে হয় । পরবর্তীতে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে ভাইভা পরীক্ষা নিয়ে চূড়ান্তভাবে নির্বাচন করা হয় ।
• পড়াশোনার বাইরের কার্যক্রম :
এই কলেজে মোট ২৭টি ক্লাব রয়েছে ক্লাব রয়েছে ক্লাব গুলো হলো - ডিবেটিং ক্লাব,বিজ্ঞান ক্লাব, ম্যাথ ক্লাব, এডভেঞ্চার ক্লাব, বিজনেস ক্লাব, চেস ক্লাব, মানবিক সংঘ, ন্যাচার স্টাডি ক্লাব,ক্যারিয়ার এন্ড স্কিল ডেভেলপমেন্ট ক্লাব, রেডক্রিসেন্ট ক্লাব,নাট্যদল, আবৃত্তি দল, ইকো এন্ড স্পেস ক্লাব, ইন্টারন্যাশনাল আন্ডারস্ট্যান্ডিং ক্লাব, কালচারাল ক্লাব, লেখককুঞ্জ, ইংরেজি ক্লাব, আর্ট ক্লাব, এথিক্স ক্লাব, ফটোগ্রাফি ক্লাব, আইটি ক্লাব, মিডিয়া এন্ড কমিউনিকেশন ক্লাব, ইয়োগা ক্লাব, আর্থ সামাজিক ক্লাব, রোভার স্কাউট ক্লাব
এসব ক্লাব থেকে প্রতিবছরই বিভিন্ন ফেস্টের আয়োজন করা হয় যেমন - ন্যাশনাল ম্যাথ ফেস্টিভাল,ন্যাশনাল ডিবেট লীগ, ন্যাশনাল সাইন্স ফেস্টিভাল, ন্যাশনাল ন্যাচার সামিট,ন্যাশনাল এডভেঞ্চার ফেস্টিভাল, বিজনেস ফেস্ট বাংলাদেশ, ন্যাশনাল চেস কার্নিভাল,ন্যাশনাল কালচারাল ফেস্টিভাল, ন্যাশনাল ইংলিশ ফেস্টিভাল ইত্যাদি ।
এছাড়াও বছরে একবার বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা হয় এছাড়াও বিভিন্ন বিভাগীয় প্রতিযোগিতায় কলেজের দল অংশগ্রহণ করে থাকে।
• সাফল্যের গল্প:
"I am proud of having been a student of Notre Dame. I cherish many sweet memories of my days at this college. The relationship between the teachers and the students was very close and cordial. We always received personal guidance and encouragement from our teachers. There was great emphasis on academic excellence as well as on moral formation. We were taught to uphold courageously values like justice, truth and human dignity."
Dr. Kamal Hossain
(Notre Dame College: 1952-1953)
"I am proud of my college where I spent the best budding two years of my life. I wish Notre Dame the best of everything, the best of prosperity, the best of honour, the best glory."
Habibur Rahman
Notre Dame College: 1953-1955
• উপসংহার :
নটরডেম কলেজে রয়েছে একটি বন্ধুত্বপূর্ণ ও প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ। সাপ্তাহিক কুইজ এবং রেগুলার ক্লাসের মাধ্যমে ছাত্রদেরকে সবসময় পড়ালেখার মধ্যে সম্পৃক্ত রাখা হয় যা পরবর্তীতে ভর্তি পরীক্ষার জন্য সহায়ক । এছাড়াও কলেজের লাইব্রেরী, ক্লাবগুলো এবং খেলাধুলা সুযোগ সুবিধা পড়ালেখাকে আরো আনন্দঘন করে তোলে । এছাড়াও অভিজ্ঞ শিক্ষকদের নিষ্ঠার সাথে পাঠদানের জন্য ছাত্রদেরকে পড়া কলেজেই বুঝিয়ে দেওয়া হয় । এসব কারণে নটরডেম কলেজ কে বাংলাদেশের সেরা কলেজ বলা হয় ।