১২ প্রবন্ধ- নিবন্ধ রচনা
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও তার প্রতিকার
ভূমিকা: বেঁচে থাকার জন্যে আমাদের জন্যে অপরিহার্য প্রয়োজন হলো খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, বাসস্থান ও চিকিৎসা। এর মধ্যে খাদ্যের প্রয়োজন সর্বাগ্রে। কিন্তু নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের বিশেষত খাদ্যমূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় বিশ্বের দেশে দেশে খাদ্যসংকট ও দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। অনাকাঙ্ক্ষিত মূল্যবৃদ্ধির ফলে পণ্যসামগ্রী সাধারণের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাওয়ায় বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ এখন অনাহারের দ্বারপ্রান্তে। আমাদের দেশেও চাল, ডাল, তেল, লবণ, মরিচ, পেঁয়াজ, রসুন, তরকারি, দুধ, চিনি ইত্যাদি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতি জনজীবনকে করে তুলেছে অচল ও আড়ষ্ট, বিশেষ করে নিম্নআয়ের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্যে লাগামহীন এ মূল্যবৃদ্ধি অভিশাপস্বরূপ।
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সাম্প্রতিক চিত্র: বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য ক্রমাগতই বাড়ছে। ন্যায়সংগত ও নির্ধারিত মূল্য বলতে এখন আর কিছুই নেই। ২০০১ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত যদি আমরা নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের বাজারমূল্য পর্যালোচনা করি তাহলে দেখতে পাব, কী অভাবনীয় হারে মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে। অন্যান্য দ্রব্যের হিসাব বাদ দিয়ে আমরা যদি কেবল চালের মূল্যবৃদ্ধি হিসাব করি তাহলে দেখব, ২০০১ সালে যে চালের দাম ছিল ১৭ টাকা, বর্তমানে দফায় দফায় মূল্যবৃদ্ধি হয়ে সে চালের দাম হয়েছে ন্যূনতম ৫০ টাকা। বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর শিয়েন জু'র মতে ২০০৭- ০৮ অর্থবছরে চালের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে ৬০ শতাংশ, একইভাবে ভোজ্যতেল ৩২ টাকা থেকে ১১৫ টাকা, মসুর ডাল ৩৫ থেকে ৯৫ টাকা, আটা ১২ থেকে ৪৫ টাকা, গরুর মাংস ৭০ থেকে ২৬০-২৭০ টাকা, কাঁচামরিচ ৪০ থেকে ১০০ টাকায় বৃদ্ধি পায়। অন্যান্য দ্রব্যেরও মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে অভাবনীয় হারে। ২০১১-১২ অর্থবছরে বাজার পরিস্থিতি এতই অনিয়ন্ত্রিত যে এখন প্রতিমাসে এমনকি প্রতিসপ্তাহে মূল্য বেড়ে চলেছে। এতে জনসাধারণের জীবনযাপন হয়ে পড়েছে দুর্বিষহ। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা 'সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)'-এর হিসেবমতে, ২০০৭- সালের জানুয়ারি থেকে ২০১২ সালের মার্চ পর্যন্ত চালের দাম বেড়েছে ৬৬.১৯ শতাংশ। আমাদের দেশে এ পরিমাণ বৃদ্ধি মূল্যে এক কেজি চাল কিনে জীবন চালানোর সামর্থ্য অনেকেরই নেই। একই সাথে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের পরামর্শে গ্যাস, পানি ও বিদ্যুতের মূল্য দফায় দফায় বেড়ে যাওয়ায় জনজীবন হয়ে পড়েছে অসহায়।
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণ: দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি বর্তমানে একটা ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। নানান কারণে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেয়ে থাকে। যেমন-
১. চাহিদা ও জোগানের ভারসাম্যহীনতা: দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির অন্যতম কারণ এটি। ক্রেতার চাহিদানুযায়ী সরবরাহ না থাকায় অনিবার্যভাবে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ঘটে।
২. অসাধু ব্যবসায়ীদের চক্রান্ত: স্বার্থান্বেষী ব্যবসায়ী মহল মজুতদারির মাধ্যমে বাজারে আকস্মিক কৃত্রিম মূল্যবৃদ্ধি ঘটায়। হঠাৎ করে তারা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বাজার থেকে গায়েব করে ফেলে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে এবং পরবর্তীতে ক্রেতার চাহিদা বেড়ে গেলে বেশি মূল্যে বাজারে ছাড়ে।
৩. বৈদেশিক রপ্তানি: বিদেশে যেসব পণ্য রপ্তানি করে বেশি লাভ হয়, রপ্তানিকারকেরা সেসব পণ্য বিদেশে রপ্তানি করে। এতে করে দেশে পণ্য ঘাটতি ঘটে এবং মূল্য বৃদ্ধি পায়।
৪. করবৃদ্ধি: অনেক সময় সরকার তার দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসন চালানোর স্বার্থে কিংবা দেশের অর্থনৈতিক ঘাটতি পূরণের লক্ষ্যে জনগণের ওপরে অধিক করারোপ করে। এ কর আদায়ের উদ্দেশ্যে পণ্যদ্রব্যের মূল্য বেড়ে যায়।
৫. চাঁদাবাজি ও দুর্নীতি: আমাদের দেশে পণ্য উৎপাদক এবং ভোস্তার মাঝে অসংখ্য স্তরে চাঁদাবাজরা সক্রিয় থাকে এবং তাদের চাঁদা দিতে দিতে পণ্যের মূল্য অনেক বেড়ে যায়। তারা সাধারণত পরিবহন সেক্টর এবং ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে অবৈধ চাঁদা আদায় করে, যার প্রভাব পড়ে পণ্যদ্রব্যের ওপর।
৬. সংরক্ষণ, সরবরাহ ও বন্টনে অব্যবস্থা: রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং সামাজিক অস্থিরতার কারণে সৃষ্ট হরতাল, ধর্মঘট, অবরোধ ইত্যাদির কারণেও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়। এসব ক্ষেত্রে পরিবহন ব্যবস্থা বন্ধ থাকায় বাজারে দ্রব্য সরবরাহ কমে যায়, ফলে মূল্য বৃদ্ধি পায়। এর ওপর পরিবহন খরচ বৃদ্ধি ও বণ্টনে অব্যবস্থার ফলেও মূল্যবৃদ্ধির কবলে পড়তে হয়।
৭. বিশ্ববাজারে মূল্যবৃদ্ধি: বর্তমানে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা। উন্নয়নশীল দেশ থেকে উন্নত দেশগুলো পর্যন্ত এ সমস্যার হাত থেকে রেহাই পায়নি। ফলশ্রুতিতে আমদানিকৃত দ্রব্যের মূল্য বাড়ছে। তবে আফসোস, এ বিশ্ববাজারে অনেক সময় দ্রব্যের মূল্য কমে এলেও আমাদের দেশে মূল্যহ্রাসের কোনো প্রভাব পড়ে না।
৮. জনসংখ্যা বৃদ্ধি: অধিক জনসংখ্যা আমাদের দেশের একটা অন্যতম বৃহৎ সমস্যা। বাড়তি জনসংখ্যার জন্যে প্রয়োজন বাড়তি পণ্যের ব্যবস্থা করা। কিন্তু জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে উৎপাদন বৃদ্ধি সম্ভব হয় না বলে বাজারে পণ্যঘাটতির সৃষ্টি হয়। এতে করে মূল্য বেড়ে যায়।
৯. চোরাচালান: কিছু অসাধু ব্যবসায়ী অধিক মুনাফা লাভের আশায় দেশীয় পণ্য চোরাপথে বিদেশে পাচার করে দেয়। এতে করে দেশে ঐসব পণ্যের দাম বেড়ে যায়।
১০. প্রাকৃতিক দুর্যোগ: ঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমাদের দেশের প্রায় নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। এ ধরনের দুর্যোগ নষ্ট করে দেয় অনেক খাদ্যপণ্য। ফলে খাদ্যদ্রব্যের ঘাটতি সৃষ্টি হয়। আবার দুর্যোগের ফলে অনেক সময় একস্থান থেকে অন্যস্থানে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায়ও পণ্য সরবরাহ ব্যাহত হয় বলে পণ্যের দাম বেড়ে যায়।
এছাড়া আমদানিকৃত পণ্যের ওপর যে শুল্কভার আরোপ করা হয়, তাতেও পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পায়। এতে দুর্ভোগ বাড়ে জনগণের। কেননা পণ্যের ওপর যে করারোপ করা হয় তা প্রকারান্তরে জনগণকেই বহন করতে হয়।
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিক্রিয়া: খাদ্যদ্রব্যের তথা নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধির সবচেয়ে বড় প্রতিক্রিয়া হলো নতুন করে দারিদ্র্যের জন্ম দেওয়া। বিশ্বব্যাংকের হিসেবে ধারণার চেয়েও বিশ্বে বেশি হারে বাড়ছে দারিদ্র্য। বিশ্বব্যাপী দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেড়ে ১৪০ কোটিতে উঠে গেছে। অথচ চার বছর আগেও ছিল ৯৮ কোটি ৫০ লাখ। এর কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে সৃষ্ট খাদ্যসংকট। ২০১১ সালের শেষদিক থেকে ২০১২ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত এ প্রবণতা ছিল চরম। একই সময়ে বিশ্বে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা বেড়েছে ৫ কোটি। আমাদের দেশেও প্রতিটি পণ্যের দাম বেড়েছে। আর তাতে সীমিত আয়ের মানুষের কষ্ট বেড়েছে সবচেয়ে বেশি। অধিক ব্যয় করার ক্ষমতা এদেশের অধিকাংশ মানুষের নেই। কিন্তু পণ্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে এ পরিস্থিতিতে খাপ খাওয়াতে গিয়ে নেমে যাচ্ছে জীবনের মান, কমছে শিক্ষা ও সংস্কৃতির মান। শিশুরাই সবচেয়ে বেশি এ পরিস্থিতির শিকার হচ্ছে। খাদ্যাভাবে অপুষ্টিতে ভুগছে হাজার হাজার শিশু। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় অনাহারী মানুষের সংখ্যা বাড়ছে, সাথে সাথে বাড়ছে সহিংসতা ও সামাজিক অস্থিরতা। কেননা পণ্যমূল্য বৃদ্ধিতে জীবনধারণের জন্যে বাড়তি আয়ের উদ্দেশ্যে মানুষ অবৈধ উপার্জনের দিকে মনোযোগী হয়ে পড়ে।
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিকার: দেশকে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে হলে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রতিকার করার জন্যে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া অত্যন্ত জরুরি। এক্ষেত্রে প্রথমেই সরকার একটি দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ নীতিমালা প্রণয়ন করতে পারে। এ আইনের আওতায় দ্রব্যের মূল্য নির্ধারণ, চোরাকারবারি প্রতিরোধ, অসাধু ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য হ্রাস, দ্রব্যমূল্যের নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি ব্যবস্থা গ্রহণ করে সরকার এ পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে পারে। এ ব্যাপারে তদারকির জন্যে সরকার 'পণ্যমূল্য মনিটরিং সেল' নামে একটি সেল গঠন করে জোরদার ভূমিকা নিতে পারে। অভ্যন্তরীণ উৎপাদিত পণ্যের সঠিক ব্যবস্থাপনা ও সরকারিভাবে বাজারজাতকরণের মধ্য দিয়ে এ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা যায়। আমাদের অর্থনীতি কৃষিপ্রধান অর্থনীতি। এক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে কৃষিখাতে ভর্তুকির ব্যবস্থা করতে হবে। দরিদ্রপ্রধান দেশে সরকারের প্রয়োজন দরিদ্রদের জন্যে ভর্তুকি দিয়ে খাদ্যপণ্যের ব্যবস্থা করা। সরকারিভাবে চাল মজুদ করতে হবে যেন বাজারে সংকটপূর্ণ মুহূর্তে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা যায়। রাজনৈতিক সহনশীলতা ও সমঝোতার মাধ্যমে হরতাল, ধর্মঘট অবরোধ ইত্যাদি থেকে বিরত থাকতে হবে। তবেই দেশের জনগণ তথা দেশীয় অর্থনীতি লাগামহীন দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধির ফলে সৃষ্ট বিরূপ পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পাবে।
উপসংহার: নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের ঊর্ধ্বমুখী মূল্যবৃদ্ধি সীমিত আয়ের মানুষের জীবনকে করছে জর্জরিত। এক্ষেত্রে ব্যবসায়ী, সরকার ও জনগণের সার্বিক অংশগ্রহণেই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। তবেই আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ জীবনধারণে স্বস্তিবোধ করবে। তবে বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাবে যেভাবে জিনিসের দাম বেড়েছে, তার সঠিক প্রতিরোধ বাংলাদেশের একার পক্ষে সম্ভব নয়। তবুও দেশীয় অর্থনীতিকে সচল রাখার জন্যে যতটুকু সম্ভব চেষ্টা করে যেতে হবে সবাইকে।
Ai এর মাধ্যমে
১০ লক্ষ+ প্রশ্ন ডাটাবেজ
প্র্যাকটিস এর মাধ্যমে নিজেকে তৈরি করে ফেলো
উত্তর দিবে তোমার বই থেকে ও তোমার মত করে।
সারা দেশের শিক্ষার্থীদের মধ্যে নিজের অবস্থান যাচাই