১২ প্রবন্ধ- নিবন্ধ রচনা
মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আজকের বাংলাদেশ।
ভূমিকা: বাঙালির সুদীর্ঘকালের ইতিহাস থেকে জানা যায় যে এ জাতি চিরকালই মুক্তিপ্রিয়। বাঙালির প্রাকৃতিক পরিবেশেই আছে তার প্রতিবাদের ভাষা। পরের বশ্যতা এ জাতি কোনোকালেই মেনে নিতে পারেনি। তাই বারবার এ ভূমিতে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠেছে। সেই আগুনে তার শৌর্য- বীৎ দীপ্ত হয়ে উঠেছে। ১৯৭১ সালে এক রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাঙালি অর্জন করে তার প্রাণপ্রিয় স্বাধীনতা। ১৯৭১ সালের ঐতিহাসিক মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল যে বোধ বা চেতনাকে কেন্দ্র করে তারই নাম মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। ত্রিশ লাখ প্রাণের বিনিময়ে আমরা যে স্বাধীনতা অর্জন করেছি তাকে চিরসমুন্নত রাখার ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রেরণা জোগাবে আবহমান কাল।
মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি: ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসনের জাঁতাকলে প্রায় ২০০
বছর ধরে নিষ্পেষিত হয়েছিল এ জাতি। ১৯৪৭ সালে সেই জাঁতাকল থেকে এ উপমহাদেশের মানুষ মুক্তিলাভ করলেও মুক্তি আসেনি বাঙালি জাতির। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানি শাসকদের শৃঙ্খলে আবার বন্দি হলো বাঙালি জাতি। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে ধাপে ধাপে সংগ্রাম করে এ বন্দিদশা থেকে মুক্তির পথ খুঁজছিল বাঙালি জাতি।
১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানি শাসনের প্রথম বলির শিকার হন ভাষাশহিদ রফিক, জব্বার, সালাম, বরকত প্রমুখ। '৫৪ সালে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে যুক্তফ্রন্টের ২১ দফার জয়লাভ; ৫৮ সালে আইয়ুব খানের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন হতে '৬৬-র ছয় দফা আন্দোলন; '৬৯- এর নজিরবিহীন ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানসহ বিভিন্ন গণআন্দোলনের মধ্যে দিয়ে বিকাশ লাভ করে আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলন। ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯টি আসনের মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ১৬৭টি আসনে জয়লাভ করে। দশ দিন পর ১৭ ডিসেম্বর প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনেও ৩১০টি আসনের মধ্যে ২৯৮টি আসনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে। এরপর ক্ষমতা হস্তান্তরে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার গড়িমসি ও ভুট্টোর ভেটো অব্যাহত থাকে। অবশেষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে ১ মার্চ হতে ২৫ শে মার্চ পর্যন্ত নজিরবিহীন অসহযোগ আন্দোলন চলতে থাকে। লাখ লাখ জনতার উপস্থিতিতে ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণে স্বাধীনতাসংগ্রামে 'যার যা কিছু আছে' তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করার আহ্বান জানানো হয়। সর্বশেষ ২৫ শে মার্চ রাতে নিরস্ত্র ও ঘুমন্ত বাঙালির ওপর পাক-বাহিনীর বর্বর আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৫শে মার্চ মধ্যরাত, অর্থাৎ ২৬ শে মার্চের প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এর পরেই 'বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো'- এ স্বতঃস্ফূর্ত স্লোগান দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়।
মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাপ্রবাহ: ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি
হানাদার বাহিনী অতর্কিতে হামলা চালায় নিরস্ত্র বাঙালির ওপর। তারা নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালায় পিলখানা, রাজারবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। মধ্যরাতের পর হানাদার বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। গ্রেফতারের পূর্বেই, অর্থাৎ ২৬ শে মার্চের প্রথম প্রহরে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তাঁর স্বাক্ষরিত ঘোষণা বার্তাটি তৎকালীন ইপিআর-এর ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রেরণ করা হয়। এরপর চট্টগ্রামের 'স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র' থেকে ২৬ ও ২৭ শে মার্চ বঙ্গবন্ধুর নামে প্রচারিত হয় স্বাধীনতার ঘোষণা। সারা বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে স্বতঃস্ফূর্ত মুক্তির সংগ্রাম। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপরাষ্ট্রপতি, তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী, এম মনসুর আলীকে অর্থমন্ত্রী, এএইচএম, কামারুজ্জামানকে স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী এবং খোন্দকার মোশতাক আহমদকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী করে মুজিবনগরে বসে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার গঠন করা হয়। অস্থায়ী সরকারের এক আদেশে আওয়ামী লীগের নির্বাচিত এম.এন.এ. অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল (পরবর্তীতে জেনারেল) এমএজি ওসমানীকে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি করে সমগ্র বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয় এবং ১১ জন সেক্টর কমান্ডারকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। ১৯৭১-এর ১৭ এপ্রিল বৃহত্তর কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলাকে 'মুজিবনগর' নামকরণ করে সেই মুক্ত ভূ-খন্ডে দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে অদ্বায়ী সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্যগণ শপথ গ্রহণ করেন। এ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক সনদ বা ঘোষণাপত্র পাঠ করেন আওয়ামী লীগের নির্বাচিত এমএনএ, মুহম্মদ ইউসুফ আলী। একই অনুষ্ঠানে কর্নেল এমএজি ওসমানীকে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করা হয় এবং কর্নেল এমএজি, ওসমানীর নেতৃত্বে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়।
৪ ডিসেম্বর হতে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর যৌথ আক্রমণ শুরু হয়। ৬ ডিসেম্বর ভারত সর্বপ্রথম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। দেশের অভ্যন্তরে পাকবাহিনী মরণকামড় দিয়ে গণহত্যা, ধর্ষণ ও নির্যাতন চালাতে থাকে। পাকবাহিনীর সমর্থনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রশান্ত মহাসাগর হতে মার্কিন সপ্তম নৌবহরকে বঙ্গোপসাগরের দিকে প্রেরণ করে। বাংলাদেশের পক্ষ নিয়ে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন সপ্তম নৌবহরকে অগ্রসর না হওয়ার জন্য হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে। এ নিষেধ উপেক্ষা করে সপ্তম নৌবহর যদি বঙ্গোপসাগরে আসত তাহলে হয়তো আমাদের মুক্তিযুদ্ধ বিশ্বযুদ্ধে পরিণত হতো। পরাজয় নিশ্চিত বুঝতে পেরে বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করার উদ্দেশ্যে পাকবাহিনী আলবদর, রাজাকারদের সহযোগিতায় ১৪ই ডিসেম্বর অসংখ্য বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করে। অবশেষে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বিকাল ৫টা এক মিনিটে রমনা রেসকোর্স (বর্তমানে সোহরাওয়াদী উদ্যান) যৌথ কমান্ডের পক্ষে লেফটেন্যান্ট জেনালের জগজিৎ সিং অরোরা এবং পাকিস্তানি বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের পক্ষে লেফটেন্যান্ট জেনালের নিয়াজি পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করেন। এ সময় মুক্তিবাহিনীর প্রতিনিধিত্ব করেন ডেপুটি চিফ (অব. স্টাফ গ্রুপ) ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা: ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে আমাদের যে সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল গড়ে উঠেছে তার মূলে কাজ করেছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকশিত হয়েছে আমাদের সমাজজীবনে। ব্যক্তিস্বাধীনতা, নারীমুক্তি আন্দোলন, নারীশিক্ষা, গণশিক্ষা, সংবাদপত্রের ব্যাপক বিকাশ সর্বোপরি গণতান্ত্রিক অধিকার চেতনা ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হয়েছে সমাজে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ১৯৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের জন্ম দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করেছে দেশে গণতান্ত্রিকব্যবস্থা এবং অবাধ স্বাধীন গণতন্ত্র চর্চার মধ্য দিয়ে পর্যায়ক্রমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সংসদীয় গণতান্ত্রিক পদ্ধতি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আমাদের সাহিত্যে এক নবতর সাহিত্যধারার জন্ম দিয়েছে। বাংলাদেশে সাহিত্যচর্চা আজকে যতটা ব্যাপ্তি পেয়েছে তার পেছনে বড়ো প্রেরণা ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আমাদের সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে প্রকাশিত হয়েছে সংগীত এবং নাটকের মধ্য দিয়ে। গণসচেতনতামূলক বক্তব্যধর্মী নাটক ব্যাপকভাবে রচিত হয়েছে স্বাধীনতার পর। আমাদের দেশাত্মবোধক গানের ক্ষেত্রে এক নতুন জোয়ার এনেছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। অসংখ্য গীতিকার তাঁদের গানে মুক্তিযুদ্ধের বিজয়গাথা রচনা করেছেন। তবে আমাদের চলচ্চিত্রে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আশানুরূপভাবে প্রতিফলিত হয়নি। খুব সামান্যসংখ্যক চলচ্চিত্রেই মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাথা প্রকাশ পেয়েছে।
উপসংহার: মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে কঠিন আত্মত্যাগের মাধ্যমে ১৯৭১ সালে আমরা যে স্বাধীনতা অর্জন করেছি তা হচ্ছে রাজনৈতিক স্বাধীনতা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তখনই পূর্ণাঙ্গ সাফল্যে উদ্ভাসিত হবে, যখন রাজনৈতিক স্বাধীনতা আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক স্বাধীনতায় রূপান্তরিত হবে। সেই লক্ষ্যে আজ সমাজের সর্বস্তরে মুক্তিযুদ্ধের মহান চেতনাকে ছড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন। দেশের প্রত্যেক মানুষের কাছে মুক্তিযুদ্ধের মহৎ লক্ষ্যসমূহ তুলে ধরে, সেগুলো বাস্তবায়নে সকলকে সম্পৃক্ত করা গেলেই আমাদের স্বাধীনতা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এক গৌরবময় স্তরে উত্তীর্ণ হবে।
Ai এর মাধ্যমে
১০ লক্ষ+ প্রশ্ন ডাটাবেজ
প্র্যাকটিস এর মাধ্যমে নিজেকে তৈরি করে ফেলো
উত্তর দিবে তোমার বই থেকে ও তোমার মত করে।
সারা দেশের শিক্ষার্থীদের মধ্যে নিজের অবস্থান যাচাই