বাংলাদেশ বিষয়াবলি
'রাষ্ট্রের পছন্দকৃত জীবন পদ্ধতিই সংবিধান।' বাংলাদেশ সংবিধানের সংশোধনীর আলোকে উক্তিটি ব্যাখ্যা করুন।
উক্তির তাৎপর্য:
উক্তিটি নির্দেশ করে যে, একটি রাষ্ট্রের সংবিধান কেবল আইনের একটি সংকলন নয়, বরং এটি সেই রাষ্ট্রের পছন্দকৃত জীবন পদ্ধতির প্রতিফলন। সংবিধান রাষ্ট্রের মৌলিক নীতি, মূল্যবোধ এবং লক্ষ্য নির্ধারণ করে এবং নাগরিকদের মধ্যে সম্পর্কের নিয়মকানুন স্থাপন করে।
বাংলাদেশ সংবিধানের সংশোধনীর আলোকে ব্যাখ্যা:
বাংলাদেশের সংবিধান স্বাধীনতা যুদ্ধের আদর্শের উপর ভিত্তি করে প্রণীত হয়েছিল, যার মধ্যে রয়েছে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মনিরপেক্ষতা।
সংবিধানের বিভিন্ন ধারা:
প্রস্তাবনা: সংবিধানের প্রস্তাবনা রাষ্ট্রের মৌলিক নীতি ও লক্ষ্য নির্ধারণ করে। এতে বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ এবং জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র হবে।
মৌলিক অধিকার: সংবিধানের অধ্যায় দুই-এ নাগরিকদের মৌলিক অধিকার নির্ধারণ করা হয়েছে। এই অধিকারগুলির মধ্যে রয়েছে সমতা, স্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা, জীবনের অধিকার এবং আইনের শাসনের অধিকার।
রাষ্ট্রীয় নীতি: সংবিধানের অধ্যায় তিন-এ রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণ করা হয়েছে। এই নীতিগুলি রাষ্ট্রকে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মনিরপেক্ষতার নীতির উপর ভিত্তি করে পরিচালনা করার দিকনির্দেশনা দেয়।
সরকারের কাঠামো: সংবিধানের অধ্যায় চার-এ সরকারের কাঠামো নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে রাষ্ট্রপতি, সংসদ, মন্ত্রিসভা এবং বিচার বিভাগের ক্ষমতা ও দায়িত্ব নির্ধারণ করা হয়েছে।
সংবিধানের সংশোধনী:
বাংলাদেশের সংবিধান বিভিন্ন সময়ে সংশোধিত হয়েছে। এই সংশোধনীগুলি রাষ্ট্রের পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে তাল মিলিয়ে নেওয়ার জন্য করা হয়েছে। উল্লেখযোগ্য কিছু সংশোধনী হল:সংবিধানের প্রথম সংশোধনী (১৯৭৩)
বাংলাদেশের সংবিধানের প্রথম সংশোধনী ১৯৭৩ সালে গৃহীত হয়, যা সংবিধানের ৩৩নং অনুচ্ছেদে পরিবর্তন আনে। এতে বন্দিদের নির্দিষ্ট কিছু অধিকার সীমিত করা হয়েছিল, যা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এই সংশোধনীটি মূলত দেশকে যুদ্ধাপরাধীদের থেকে মুক্ত করার জন্য প্রয়োজনীয় ছিল, যা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সংরক্ষণ করেছিল।
সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী (১৯৭৫)
১৯৭৫ সালে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক কাঠামোতে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনে। এই সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার পদ্ধতি চালু করা হয় এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সীমিত করা হয়। এটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সময়কালীন রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রতিফলন ছিল, যা একদলীয় বাকশালের প্রবর্তনের পথ প্রশস্ত করে। যদিও এই সংশোধনীটি পরবর্তীতে ব্যাপক সমালোচনার সম্মুখীন হয় এবং ১৯৯১ সালে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ফলস্বরূপ সংসদীয় সরকার পদ্ধতি পুনর্বহাল হয়।
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী (২০১১)
পঞ্চদশ সংশোধনীটি বাংলাদেশের সংবিধানের একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন। এই সংশোধনীতে ধর্মনিরপেক্ষতার নীতির পুনঃপ্রবর্তন, বঙ্গবন্ধুর ঘোষিত চারটি মূলনীতি - গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, এবং জাতীয়তাবাদ - সংবিধানের মূল ভিত্তি হিসেবে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। এছাড়াও, এই সংশোধনীতে ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানে ফিরে যাওয়ার প্রয়াস দেখা যায়।
সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী (২০১৪)
ষোড়শ সংশোধনী ২০১৪ সালে পাস হয়, যা বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে দেয়। এই সংশোধনীটি বিচার বিভাগের স্বাধীনতার উপর একটি বড় বিতর্ক সৃষ্টি করে এবং পরবর্তীতে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ দ্বারা বাতিল করা হয়। এই সংশোধনীটি প্রমাণ করে যে সংবিধান কেবলমাত্র রাষ্ট্রের পছন্দকৃত জীবন পদ্ধতির প্রতিফলন নয়, বরং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের প্রতিও সংবেদনশীল।
সংবিধানের সতেরোতম সংশোধনী (২০১৮)
সতেরোতম সংশোধনীটি জাতীয় সংসদে মহাজোট সরকারের সময় পাস হয়, যা সংসদের নির্বাচনী এলাকাগুলি পুনর্বিন্যাস করে। এটি মূলত বর্তমান সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে আসন্ন নির্বাচনের জন্য উপযুক্ত ছিল।
সংবিধানের জীবন্ত দলিল
উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট যে সংবিধান একটি জীবন্ত দলিল, যা সময়ের সাথে সাথে রাষ্ট্রের প্রয়োজন, সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়। সংবিধানের প্রতিটি সংশোধনী রাষ্ট্রের পছন্দ ও নীতির প্রতিফলন করে এবং রাষ্ট্রের জীবনের পদ্ধতির পরিবর্তন ও উন্নতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে পরিবর্তিত হয়।
উপসংহার
"রাষ্ট্রের পছন্দকৃত জীবন পদ্ধতিই সংবিধান" উক্তিটি বাংলাদেশের সংবিধানের পরিবর্তনশীল ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। সংবিধানের বিভিন্ন সংশোধনী রাষ্ট্রের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পছন্দ ও প্রয়োজনের প্রতিফলন করে। বাংলাদেশের সংবিধান শুধু আইনগত নথি নয়, এটি রাষ্ট্রের মূল্যবোধ, আদর্শ ও প্রয়োজনের প্রতিফলন যা সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয় এবং উন্নত হয়।
এটি দেখায় যে সংবিধান কেবল একটি স্থির নথি নয়, বরং একটি জীবন্ত দলিল যা রাষ্ট্রের প্রয়োজন ও পছন্দের সাথে সামঞ্জস্য রেখে পরিবর্তিত হয় এবং উন্নত হয়। সংবিধান তাই রাষ্ট্রের পছন্দকৃত জীবন পদ্ধতির একটি প্রতিচ্ছবি।
Ai এর মাধ্যমে
১০ লক্ষ+ প্রশ্ন ডাটাবেজ
প্র্যাকটিস এর মাধ্যমে নিজেকে তৈরি করে ফেলো
উত্তর দিবে তোমার বই থেকে ও তোমার মত করে।
সারা দেশের শিক্ষার্থীদের মধ্যে নিজের অবস্থান যাচাই